একজন চিকিৎসকের মন্তব্য এবং আমার জবাব

Doctor

ছবি : দ্য টেলিগ্রাফ

বাংলানিউজে ২২ ডিসেম্বর একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখার জবাবে একজন তরুণ চিকিসৎক এবং আমার সতীর্থ একটি মন্তব্য করেছেন। সেই মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়েইে এত্তো বড় লেখার অবতারণা! তাকে ফেসবুকে আমি যা বলতে চেয়েছি — “আপনি অবশ্যই যুক্তিখণ্ডন করতে পারেন। কিন্তু যুক্তিখণ্ডনের নামে আপনি প্রশ্ন তুলেছেন লেখকের জ্ঞান নিয়ে। প্রথমেই বলে রাখি, আমি কিন্তু লেখার মাধ্যমে আমার জ্ঞানের পরীক্ষা দিতে যাই নি! এছাড়া আপনি চলে গেছেন আধ্যাত্মিক লাইনে। কারণ গুটিকয়েক চিকিৎসককে নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানেই যে — (‘প্রক্ষান্তরে বাংলাদেশকেই অপমান করা হয়েছে’) সবাইকে তিরস্কার করা হয়েছে তা নয়!

বাংলাদেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থা কিংবা চিকিৎসকদের কটাক্ষ করা আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল না। আর আমি কোনোভাবেই দেশের সকল চিকিৎসককে খারাপ বলি নি। এমনকি আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বেশিরভাগই ভালো। বাংলাদেশের অনেক চিকিৎসককে এক নামে চেনে। আর আমি খুব ভালো করেই জানি, অস্ত্রোপচার না করা লাগলে হাড়ভাঙার তেমন কোনো চিকিৎসার দরকার পড়ে না। হাড় এমনিতেই জোড়া লাগে। কিন্তু আপনি আমাকে বলুন, বাংলাদেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থা নিয়ে দেশের ক’জন মানুষ সন্তুষ্ট? আগে মানুষ বিলাসিতা করতে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত যেতো। আর এখন কষ্ট করে হলেও টাকা জমায়। আর সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতে বিদেশ যায়।

আপনি আমাকে বলুন, প্রায়ই কেন খবর শোনা যায় হাসপাতাল ভাঙ্চুরের? ল্যাবএইড, ইউনাইটেড, অ্যাপোলোর মতো নামীদামি হাসপাতালও কেন বাদ যায় না ভাঙ্চুরের হাত থেকে? এখনও কেন ইউরিন নিয়ে ব্লাডের রিপোর্ট দেওয়া হয়? এমন ‘মানবিক ভুল’ বিদেশে কেন শোনা যায় না? কখনও কি শুনেছেন, ভুল চিকিৎসার অভিযোগে বিদেশের কোনো হাসপাতাল ভাঙ্চুর হয়েছে? আমি জানি, বাংলাদেশের অনেক অপ্রতুলতা রয়েছে। রোগী দেখার কথা ১০টা কিন্তু আপনাকে দেখতে হয় ১০০টা। রোগনির্ণয়-ব্যবস্থায়ও ত্রুটি রয়েছে। দক্ষ-জনশক্তির অভাব রয়েছে। কিন্তু এসব তো আপনাকে মেনে নিতেই হবে। তা মেনে না নিয়ে আপনি যদি “আমরা কখনো বিদেশে গেলে সেখানে কি স্বর্গে আছি” টাইপের কথাবার্তা বলেন তাহলে তো হবে না। আর বলে রাখি, আমি ‘কখনও বিদেশ’ গিয়েছি বিষয়টা এমন নয়। অনেক দেশে গিয়ে, সম্যক ধারণা নিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করেছি।

স্বদেশের তুলনায় বিদেশ কারও জন্য কখনওই স্বর্গ হতে পারে না। কিন্তু তা-ই বলে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে আপনি বাংলাদেশের সার্বিক চিকিৎসা-ব্যবস্থাকে সমান নম্বর দিতে পারেন না। জার্মানিতে ভালো চিকিৎসা হয়, তা সর্বজনবিদিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, স্বাস্থ্যসেবায় ফ্রান্স একনাম্বারে আর বাংলাদেশ ৮৮ নাম্বারে। আমি-আপনি, স্বীকার-অস্বীকার যা-ই করি না কেন!

আর একটা কথা, আপনি হয়তো ওষুধ কোম্পানির গিফ্টটা (ঘুষ) নেন না, তাদের টাকায় বৌসহ বিদেশ ঘুরেন না, আপনি হয়তো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশন খান না, কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনার দু-চারজন সহকর্মী কি তা করে না? তাহলে সারাদেশে হিসেব করলে সেই পার্সেন্টেজ কত দাঁড়ায়? আপনাদের কি কোনো অধিকার আছে, আমাকে আপনার ইচ্ছেমতো ওষুধ কোম্পানির নাম বলে ওষুধ খাওয়ানোর? পছন্দমাফিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানোর? আপনি ওষুধের জেনেরিক নাম বলে দিন, টেস্টের নাম লিখে দিন — আমি ওষুধ খেয়ে নেব, টেস্ট করিয়ে নেব। আর কেউ যদি তা না করতে সক্ষম হয় তবে আপনার সাহায্য চাইলে ব্র্যান্ডের নাম লিখে দিন।

শেষ কথা, আপনি যতদিন ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার চেয়ে কমদিন ধরে আমি সেই ফিল্ডে ঘুরি না। কিন্তু আমি যেহেতু সরাসরি ছাত্র না, তাই জ্ঞান আমার একটু কম থাকতেই পারে। কিন্তু আমার দু-একজন চিকিৎসক বন্ধু আছেন যারা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক-অধ্যক্ষ পর্যন্ত। তারা নিজেরা নিজেদের ত্রুটির কথা মেনে নেন। কারণ তারা ভালোভাবেই জানেন কেউই পারফেক্ট না। আমিও আমার ত্রুটির কথা মেনে নিলাম। আপনার কাছ থেকে সেই ত্রুটিগুলোর কথা শোনার অপেক্ষায় রইলাম।

আর একটা কথা, আমার বাবাকে মেরেছেন তারই বন্ধু, যিনি চিকিৎসক। আমার বোনের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু মাত্র ৩২ বছর বয়সে তাকে মরতে হলো। কারণ শুধু জ্বর। এবং আমাদের চিকিৎসকরা কিংবা রোগ নির্ণয়কারীরা সেই জ্বরের কারণও নির্ণয় করতে পারলেন না। আমি সাংবাদিক, কিন্তু যদি সংবাদের ইন্ট্রোই লিখতে না পারি তবে আমি কেমনতর সাংবাদিক???”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *