চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটা সংবাদ এবং কিছু কথা

চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণের সাম্প্রতিক একটা নিউজ নিয়ে চবিয়ানদের মধ্যে বেশ খুশি খুশি ভাব, বেশ মাতামাতি! বাস্তবতা হচ্ছে, এটা কোনো নিউজই না। যিনি নিউজ করেছেন তাঁর জানার পরিধি কম থাকতে পারে, কিন্তু যিনি বা যাঁরা এটা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন তাঁরা খোঁজখবর না নিয়েই এটি ছেপেছেন। আর যাঁরা শেয়ার করছেন তাঁরা তো কেমিস্ট্রিটা বুঝার ধারেকাছেও নেই।

এই বিষয়ে একটু পরে আসি। তার আগে একটা ঘটনা শেয়ার করি পূর্বকোণ সম্পর্কে।

চট্টগ্রামের আজাদী-পূর্বকোণ যেমন কিছুটা ভাই-ভাই আবার তেমনি প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে বেশ প্রতিযোগিতা, কি ব্যবসায় কি নিউজে— সবদিক দিয়ে। যদিও প্রতিষ্ঠান দুটি যার যার জায়গায় সেরা।

যা-ই হোক, আমি তখন কাজ করি দৈনিক আজাদী’র ঢাকা অফিসে। কিংবদন্তী সাংবাদিক দৈনিক আজাদী’র সম্পাদক শ্রদ্ধেয় এমএ মালেক স্যার জরুরি কাজ থাকলেই কেবল ঢাকায় আসেন। ঘটনার দিন তিনি খুব সকালের ফ্লাইট ধরে ঢাকায় আসলেন। আমি জ্যাম ঠেলে মিরপুর থেকে মালিবাগের অফিসে গিয়ে দেখি তিনি ব্যুরো চিফ ওয়াহিদউল্লাহ ভাইয়ের রুমে। আমিই লেট।

রুমে ‍ঢুকে সালাম দিতেই তিনি হাতে থাকা পূর্বকোণ আর আজাদী দেখালেন। বললেন, খোঁজখবর কিছুই রাখো না। কাজটাজ কী করো? এতো বড় নিউজ মিস হয় কীভাবে? ততক্ষণে আমার চোখ লাল হয়ে গেছে, লজ্জায় কান গরম হয়ে গেছে।

purbokone news

বললাম, কোন্ নিউজ স্যার? নিউজটা ছিলো সম্ভবত লালকালির ৬ কলামের হেডলাইন, ‘চট্টগ্রামের ১০ চিনি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা’ (চিনি ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১২, ১০ না-কি ৮ ছিলো ভুলে গেছি)।

এটা দেখে আমার মাথা আসলেই ভো ভো করছিলো। কারণ আমি জানি এটা কত বড় খবর তখন। চিনির ব্যবসা কারা করেন। আর ঘটনাটা সরাসরি চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। তাড়াতাড়ি নিউজটা একটু পড়লাম। ইন্ট্রোতেই দেখি লেখা, ‘চট্টগ্রামের … চিনি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়’— এ জাতীয় কথাবার্তা। যা বুঝার ‍বুঝে গেলাম…

ফোন দিলাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পিআরও’কে। আমার ব্যতিব্যস্ততা দেখে তিনি জানতে চাইলেন কী হয়েছে। বললাম ঘটনা। জিজ্ঞেস করলাম, এই নিউজ সম্পর্কে। তিনি বললেন, ভাই কী বলেন! বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারে? আমি বললাম, তা তো জানি। কিন্তু ঘটনা কী হয়েছে?

তিনি বললেন, আরেহ্ তেমন কিছুই না। আমাদের প্রাত্যহিক মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে, চিনির বাজার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাপ্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেছেন, দরকার হলে চিনি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে, গ্রেপ্তার করা হবে।

ওই মিটিংয়ে কোনো সাংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন না। এই খবর পরে চ্যানেল আই-য়ের স্ক্রলে শুধু একলাইন গিয়েছিল।

news purbokone

যা-ই হোক, সব ঘটনা মালেক স্যারকে বুঝিয়ে বললাম। স্যার, মন্ত্রণালয় কি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারে? এটা ছিলো প্রাত্যহিক মিটিংয়ের অংশ; যেমনটা ৫০টার বেশি মন্ত্রণালয়ে প্রতিদিন একাধিক হতে থাকে। তিনি মুচকি হাসলেন, বললেন, তারপরও খোঁজখবর রাখিও। নিউজটিউজ যেন মিস না হয়!

যা-ই হোক, এত্তো লম্বা ঘটনার বর্ণনা যে কারণে দেওয়া… খবর হয় না, অনেকসময়ই খবর বানানো হয়।

পূর্বকোণের সাম্প্রতিক একটা নিউজ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তারা বেশ খুশি। তাঁরা বিষয়টা প্রচুর শেয়ার করছেন। তা তাঁরা করতেই পারেন। এতোবড় ইতিবাচক নিউজ শেয়ার করতে প্রবলেম কি!

নিউজটা সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলা যাক। একটা জিনিস খেয়াল করেন, যে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরা ১০০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পায় না সেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ১৭৪ জন শিক্ষক কীভাবে বিশ্বসেরা গবেষকের তালিকায় স্থান পায়? আর চবিতে যদি ৯২০ জনের মতো শিক্ষক থাকে তাহলে ১৭৪ জন শিক্ষক ‘বিশ্বসেরা গবেষক’ হয়ে গেলো? চবি’র প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষক বিশ্বসেরা গবেষক? অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড তাহলে কোথায় যাবে? নিউজের এক জায়গায় বলা হয়েছে, তালিকায় ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ১০৪ জন গবেষকের নাম স্থান পেয়েছে। আরেহ্ ভাই, পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আছে কয় লাখ? এটা একটা তালিকা, বুঝাই যাচ্ছে।

একটু কমনসেন্স খাটানো দরকার না?

যে সোর্সের রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে সেটি আসলে একটি সাধারণ ওয়েবসাইট। এমন ওয়েবসাইট আমার আছে ৪০-৫০টা। ওয়েবসাইটটির ডোমেনই কেনা হয়েছে মাত্র বছর দুয়েক আগে, ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল।

ওয়েসাইটটিতে গুগল অ্যাডসেন্সের বিজ্ঞাপনে ঠাসা (স্ক্রিনশট দেখুন)। কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, যারা এ ধরনের র‌্যাংকিং করে থাকে তারা মরে গেলেও এমন বিজ্ঞাপন বসিয়ে টাকা আয় করে না। তাদের বিজনেস-মডেল আলাদা!

তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে, সেখানে চবির যেসব শিক্ষকের নাম আছে সেগুলো তাহলে কী? সেগুলো কিছুই না। এটা বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটা ডিরেক্টরি। এই ওয়েবসাইটের কোনো আন্তর্জাতিকতার বিষয় নেই। ওয়েবসাইটটিতে নিজের নাম শিক্ষক হিসেবে নিজেই যুক্ত করার অপশন রয়েছে। যে সাইটে নিজের নাম নিজেই যুক্ত করা যায় সেটা কীভাবে আন্তর্জাতিক গবেষকের তালিকা হতে পারে, আমি জানি না।

ctg university news

চবির যেসব শিক্ষকের নাম সেখানে আছে তাঁদের কেউ কেউ হয়তো বিশ্বসেরা গবেষক। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউজ করা হয়েছে তা কেবল বলার জন্য বলা। ছোট্ট আরেকটি উদাহরণ দিই, ধরুন, আমি জার্মানি থেকে একটি ওয়েবসাইট চালাই ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্ট সোসাইটি’ নামে। সেখানে আমি একটি ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রামের ১২৭ জন সাংবাদিকের একটা তালিকা দিয়ে রাখলাম। সেটা কি আগামীকাল পূর্বকোণ নিউজ করবে যে, ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্ট সোসাইটির তালিকায় চট্টগ্রামের ১২৭ জন সাংবাদিকের নাম’! চিন্তা করলে এটাও তো নিউজ হওয়ার মতো বিষয়, তাই না?

আমার ধারণা, চবি শিক্ষকদের কেউ কেউ কারবারি করে ওই নবীন সাংবাদিককে দিয়ে নিউজটি করিয়েছে এবং পূর্বকোণের সম্পাদকীয় বিভাগ আগপাছ না ঘেঁটেই নিউজটি ছাপিয়েছে।

অবশ্য এতে করে বেশ ভালোই শেয়ার হচ্ছে কন্টেন্টটি। ভিসি-শিক্ষক-কর্মকর্তা-শিক্ষার্থী সবাই বেশ খুশি!

কোনোকিছু না থাকলে আমরা যা-তা নিয়েই খুশি হতে ভালোবাসি। জাতি হিসেবে আমরা বড্ড ইনোসেন্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *