গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর। তখনও বড়দিনের ছুটির রেশ কাটে নি। সকাল ৮টায় কাজ। আয়েশি ভঙ্গিতে ঘুম থেকে উঠে দেখি একটু দেরিই হয়ে গেল। জানালার পর্দা সরাতেই চোখ পেলো এক নতুন দৃশ্য — চারদিক শ্বেতশুভ্র! সাবানের সাদা ফেনার মতো কিংবা সাদা তুলোর মতো বরফে ছেয়ে আছে চারপাশ। এমন অদ্ভুত তুষারপাত এর আগে সরাসরি কখনও দেখা হয় নি। কেমন যেন একটা উত্তেজনা, কিছুটা অস্থিরতা আর অনেকখানি রোমান্টিকতা সাতসকালেই মনের মধ্যে চেপে বসলো। তাড়াতাড়ি শাওয়ারটা সেরে দু টুকরো পাউরুটি মুখে গুঁজে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে।
বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে কাজের জায়গায় যেতে মিনিট দশেক লাগে। নিচে নেমে দেখি পুরো সাইকেলে তুষার জমে সাদা হয়ে আছে। সামনে-পেছনের কোনো লাইটই কাজ করছে না। সাইকেলের ডায়নামো মনে হয় বরফে ড্যাম হয়ে গেছে। যা-ই হোক, বাতি ছাড়াই চালানো শুরু করলাম। যদিও পুলিশ-মামা ধরলে নির্ঘাত ১০-৪০ ইউরো জরিমানা!
মনে রোমান্টিক একটা ভাব নিয়ে সাইকেল চালাচ্ছি। কাজের জায়গার কাছাকাছি পৌঁছেও গেলাম। হয়তো আর দেড়-দুমিনিট লাগবে। কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম! হঠাৎ মনে হলো — আমি সাইকেল থেকে পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু কেন জানি পায়ের কিংবা হাতের কোনো ব্রেকই ধরছি না। এতো সুন্দর ¯েœা দেখে আমি আগ-পিছ সব ভুলে গেলাম। বরফ যে পিচ্ছিল এবং ভয়াবহ পিচ্ছিল সে কথা ঘুণাক্ষরেও মনে আসে নি। যা ঘটার তা-ই ঘটলো। ধপ্ করে পড়লাম! ডান হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলাম। মনে হলো, কিছুই হয় নি! উঠে আবার সাইকেল চালানোর চেষ্টা করলাম। পারলামও। কিন্তু দেখি ডানহাত আমার সোজা হয়ে আছে। ভাঁজ করতে পারছি না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই টের পেলাম ব্যথা কাকে বলে। তাড়াতাড়ি বস্কে ফোন দিলাম। জিজ্ঞেস করলো, অ্যাম্বুলেন্স লাগবে কি-না। আমি বললাম না হেঁটেই যেতে পারবো হাসপাতালে।
হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে গিয়ে দেখি, আমি একা নই, আমার মতো ‘বোকা’ লোক আরও আছে, যারা আমার মতোই হয়তো ‘রোমান্টিক’ হতে গিয়ে হাত-পা ভেঙে এসেছে বরফমাখা সকালে। তখও আমি জানি না, আমার ডানহাতের দুটো হাড় গুঁড়ো হয়ে গেছে!
প্রথমে এক্স-রে করা হলো। অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মীরাই তা করলেন। কারণ বড়দিনের ছুটি শেষ না হওয়ায় প্রধান চিকিৎসক আসেন নি। এক্স-রে রিপোর্ট ইমেইলে পাঠানো হলো প্রধান চিকিৎসক থমাস ম্যুলারের কাছে। তিনি বললেন, এক্স-রেতে কাজ হবে না। সিটিস্ক্যান করে সেটা তার কাছে পাঠাতে। এভাবে ঘণ্টা দুয়েক পড়ে জানানো হলো — আমার ডানহাতের দুটো হাড় গুঁড়ো হয়ে গেছে! প্লাস্টার লাগবে। মূল চিকিৎসা শুরু হবে এক সপ্তাহ পর! আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এই দূর পরবাসে কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। এক হাত দিয়ে কীভাবে সবকিছু সামলাবো?
কোনো ওষুধ দেওয়া হলো না। চিকিৎসা কেবল বিশাল মোটা প্লাস্টার! যদি ব্যথা করে তাহলে খেতে বলা হলো প্যারাসিটামল জাতীয় কিছু একটা! পরের সপ্তাহে দেখা করলাম ডাক্তার ম্যুলারের সঙ্গে। আবার এক্স-রে করালেন। তিনি হাত দেখে-শুনে বললেন, আগামী সপ্তাহে বলা যাবে অপারেশন লাগবে কি-না। আবারও ভয় পেলাম। অপারেশন! চিকিৎসক আশ্বস্ত করলেন, ভয় না পাওয়ার। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে হয়তো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে ঠিক হবে? তুমি তো কোনো ওষুধই দিচ্ছ না। সে মুচকি হেসে বললো — ডাক্তার তো আমি, না-কি! একহাজার বছর আগে কি ওষুধ ছিল? তখন মানুষের হাত-পা ভালো হতো কীভাবে? আমি টাস্কি খেয়ে গেলাম। আর বাংলাদেশের চেনাজানা কয়েকজন ডাক্তারের কথা মনে পড়লো। যাদের কাছে চিকিৎসা মানেই ওষুধ আর একগাদা টেস্ট!
এভাবে আমাকে ২১ দিন পর্যবেক্ষণে রেখে প্লাস্টার খুলে দেওয়া হলো। হাতটা তখনও ৪৫ ডিগ্রির মতো বাঁকা হয়ে আছে। মনে মনে বিরক্ত হলাম। এতো উন্নত দেশে কী চিকিৎসা করলি তোরা! আমার বাংলাদেশই ভালো! প্লাস্টার খুলে দিয়ে পাঠানো হলো ফিজিওথেরাপি সেন্টারে। চললো ২১ দিনের ব্যায়াম। প্রতিদিন সকালে সুন্দরী ফিজিওথেরাপিস্টরা তাদের কোলের ওপর আমার হাত রেখে মালিশ করে। এ যেন আমাদের দেশের কবিরাজি চিকিৎসা! প্রথমে বিশ্বাস হয় নি হাতটা ঠিকঠিক সোজা হবে। যেখানে দুটো হাড় গুঁড়ো হয়ে গেছে তা সত্যি সত্যি কীভাবে ঠিক হবে? কিন্তু সবমিলিয়ে মাসদুয়েক পরে বুঝলাম ওষুধ ছাড়াও চিকিৎসা হয়!
এই চিকিৎসার বিল হয়তো লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তবে ইন্স্যুরেন্স কাভার করায় আমাকে একটা কানাকড়িও খরচ করতে হয় নি। করার মধ্যে করতে হয়েছে সাত পৃষ্ঠার একটা ফরম ফিলআপ! কতটা কত মিনিটে ঠিক কোন্ জায়গায় কীভাবে পড়ে গেলাম, কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছিলাম, কেন যাচ্ছিলাম, সেটা কি সরাসরি বাসা থেকে না-কি কাজে যাওয়ার আগে মার্কেট বা অন্য কোথাও গিয়েছিলাম এই জাতীয় প্রশ্ন!
এমন চিকিৎসা চলাকালীন দেশের বন্ধু-সহকর্মীদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কম্পিউটার প্রকৌশলী বন্ধু সাইফুল ইসলাম দিপু ফোনে জানাচ্ছিল তার মাকে নিয়ে হয়রানির কথা। ভারতে নিয়ে গিয়ে ডেক্সা-বিএম টেস্ট করানোর পর দেখা গেলো চট্টগ্রামের এমআরআই রিপোর্টে যা বলা হয়েছিল তার ধারেকাছেও নেই ভারতের রিপোর্ট। তাকে চিকিৎসকরা রীতিমতো ভয় লাগিয়ে দিয়েছিল। অথচ খালাম্মা এখন দিব্বি সুস্থ আছেন। ভোরের কাগজের সহকর্মী রুমন ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো — ভাই এই দেশেই থাকবো না! তিনি জানালেন, গর্ভবতী স্ত্রীর জন্য কোনো কারণ ছাড়াই তার প্রায় দেড়লাখ টাকা কীভাবে খরচ করালো ডাক্তার। প্রায় একই সময়ে আমার বড় ভাইকে মগবাজারের একটি ক্লিনিকে রাখা হচ্ছিল জ্বর না কমার কারণে। জ্বরের না কমার কোনো কারণই বলতে পারে না ডাক্তাররা। ১৫-১৬ দিনে হাজার পঞ্চাশেক টাকা বিল ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো টাইফয়েড!
তুষারপাতের সময় হাতভাঙার একবছর পর আজ যখন লিখছি তখন মনে মনে শুকরিয়া আদায় করছি, কারণ এমন সম্যক একটি ধারণার আমার খুব প্রয়োজন ছিল! তা না হলে আমার জন্মভূমির সঙ্গে এখানকার চিকিৎসাব্যবস্থার পার্থক্য করতে পারতাম না। তবে হ্যাঁ, একটি বিষয় এখানে খুব মিস করি। সেটা হচ্ছে, চাইলেই দিনে দিনে যে-কোনো টেস্ট করিয়ে ফেলা। চাইলেই নিজেকে ‘সাম্বাদিক’ পরিচয় দিয়ে চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ফেলা এই দেশে একশতে একশ ভাগ অসম্ভব। মনে পড়ে, মাসছয়েক আগে পেটে যখন ব্যথা হচ্ছিল, যখন একটি অ্যান্ডোসকপি জরুরি মনে হচ্ছিল তখনও আমাকে টানা তিন-তিনটা মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল সেই কাক্সিক্ষত অ্যান্ডোসকপিটা করাতে!!! প্রকাশিত : Bangla News
মাহমুদ মনি
ডর্টমুন্ড, জার্মানি
২২ ডিসেম্বর ২০১৫