লাখো রাব্বী, কয়েকজন শিকদার!

SI Masud Shikder

কান্নারত রাব্বী, ডানে কুলাঙ্গার এসআই মাসুদ। সৌজন্যে : সময় টিভি’র ফুটেজ

রাব্বী একটি প্রতীক মাত্র। দেশে হাজারো-লাখো রাব্বী, অর্থাৎ জনগণ প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মাসুদ শিকদারদের মতো কিছু লোক সবখানেই আছে। থানায় আছে, হাসপাতালে আছে, কোর্টে আছে, কাচারিতে আছে। বাজারে আছে, বন্দরে আছে। কিন্তু ক’টা খবর আর পত্রিকায় আসে? ক’টা সংবাদ আর টিভি চ্যানেলের টপে স্থান পায়? এদের হাত সত্যিই লম্বা।

সাবেক সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীর সঙ্গে যে ঘটনা পুলিশ ঘটিয়েছে তাকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাবে না। কারণ এর আগেও পুলিশ কিংবা পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‌্যাবের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু ক’টির বিচার হয়েছে? সাময়িক বরখাস্ত করার নামই কি বিচার? কয়েকজন শিকদারের হাতে কেন একটি বাহিনীকে সবসময় কলঙ্কিত হতে হবে? কার স্বার্থে এসব শিকদারকে সবসময় বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়? আমরা ঝালকাঠির লিমনের কথা জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের কথা জানি।

টিভি নিউজে রাব্বীর যে বর্ণনা শুনলাম এবং দেখলাম তাতে সহজেই অনুমেয় রাব্বীকে সত্যিই সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে এনেছেন। তা না হলে হয়তো এতক্ষণে রাব্বীর লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য ঢামেক হাসপাতালের মর্গে গড়াগড়ি খেতো। মোহাম্মদপুর থানার কুলাঙ্গার পুলিশ কর্মকর্তা এসআই মাসুদ শিকদার খুলনার এরশাদ শিকদারকেও হার মানিয়েছে। কোনো বিচার ছাড়াই ওই ব্যাটাকে আমি সরাসরি কুলাঙ্গার বলে দিলাম। আমার কোনো কোনো সহকর্মী তাকে ফেসবুকে ‘জানোয়ার’ও বলেছেন। আমি তাই আর তা বললাম না!

টিভি সংবাদটি দেখলেই বুঝতে পারবেন রাব্বীর ওপর কতটা নির্যাতন আসলে পুলিশ করেছে!

https://www.youtube.com/watch?v=5mjbkv6S1nA

রাব্বীকে আমি কাজের সুবাদে বেশ ভালোভাবেই চিনি। তার পরিমিতিবোধ, সহাস্যবদন, সর্বোপরি বিনয় যে-কারোরই হৃদয় কাড়বে। বয়সে ছোট হলেও আমি সাধারণত খুব কম লোককেই ‘তুমি’ সম্বোধন করি। যারা সত্যিই খুব কাছের হয় তাদেরই শুধু ‘তুমি’ বলি। রাব্বী আর আমি বছরখানেক একসঙ্গে কাজ করেছি প্রকাশেয় ‘অধিনায়ক’ পত্রিকায়। সে তথনও বিশ্ববিদ্যালয় পার করে নি। পত্রিকাটি আর বের না হওয়ায় এরই মধ্যে আমাদের চলে যেতে হয় ‘আমাদের সময়ে’। আর রাব্বী যোগ দেয় ‘সময় টিভি’তে। নিজের মেধা, যোগ্যতা আর সততা দিয়ে দেশ-বিদেশে লাখো-কোটি মানুষের প্রিয় মুখ হয়ে ওঠে রাব্বী। সংবাদ উপস্থাপনায় বেশ ভালো করে সে। কত শত শিরোনাম সে পড়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু পুলিশের নির্মম, অকথ্য আর বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে চোখের পানি ঝরিয়ে নিজেই সংবাদের উপকরণ হলো রাব্বী।

গত শনিবার রাত ১১টার দিকে রাব্বী মোহাম্মদপুরে খালার বাসা থেকে কল্যাণপুর নিজের বাসায় যাচ্ছিলো। হঠাৎ পেছন থেকে এক পুলিশ সদস্য তার শার্টের কলার ধরে বলেন, ‘তোর কাছে ইয়াবা আছে।’ অস্বীকার করলে ওই পুলিশ রাব্বীকে ধরে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ শিকদারের কাছে নিয়ে যায়। এসআই মাসুদও বলে, রাব্বীর কাছে ইয়াবা আছে। আবারও অস্বীকার করলে এসআই মাসুদসহ পুলিশ সদস্যরা তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে। একপর্যায়ে তাকে জোর করে পুলিশের ভ্যানে তোলা হয়। সেখানে তাকে মারধরও করা হয়। থানায় নেওয়ার পর রাব্বীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে পুলিশ।

তল্লাশির নাম করে রাব্বীকে নিয়ে পাঁচ ঘণ্টা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে পুলিশ! ‘ক্রসফায়ার’ করে লাশ বেঁড়িবাধে ফেলে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়। গুলি করার ভয় দেখানো হয়। পুলিশ যে আসলে এমনটা মাঝে মাঝে করে তার প্রমাণ রাব্বী। সে বেঁচে না ফিরলে হয়তো আমরা প্রকৃত সত্য কখনও জানতেই পারতাম না।

ভিডিওতে দেখলাম, চোরের মার কত বড় গলা! অপরাধ করার পরও কেমন জাজ্বল্যমান মিথ্যা কথা বলছে পুলিশের সর্বশেষ ‘মহানায়ক’ মিস্টার শিকদার! মানুষের চেহারা-সুরত নিয়ে কথা বলা ঠিক না। কিন্তু একটা কথা তো মনীষীরা বহু আগেই বলে গেছেন, ফেস ইজ দ্য ইনডেক্স অব মাইন্ড। প্যারিস থেকে প্রকৌশলী কল্যাণ মিত্র বড়ুয়াও ফোনে সে কথাটিই দ্বিরুক্ত করলেন কিছুক্ষণ আগে। ভাবতে সত্যিই বড় কষ্ট হয়, আমাদের দেশের পুলিশ মানুষের বন্ধু তো দূরের কথা, মাঝে মাঝে পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করে! সুযোগ পেলেই হাড্ডির (টাকা/ঘুষ) অভাবে মানুষকে কামড়ানোর চেষ্টা করে। আরও আশ্চর্য লাগলো যখন ওই ব্যাটা শিকদারের বস্ থানার ওসি জামাল উদ্দিন তার পক্ষ নিয়ে কথা বলে। বলে না যে, যদি আমার অফিসার দোষী হয় তাহলে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। তার মানে হচ্ছে, পুলিশ রাতে যে টাকা চাঁদাবাজি করে তার সবটাই ভাগাভাগি হয়। এই টাকার ভাগ মন্ত্রী-এমপিরা পান কি-না জানি না, যদি না পান তাহলে আশা করি রাব্বী সম্ভবপর দ্রুততায় ন্যায় বিচার পাবে, আর ওই ব্যাটা পুলিশের সত্যিকারের শাস্তি হবে। কেবল লোক দেখানো ‘সাসপেন্ড’ না। পুলিশ যদি কথায় কথায় মানুষকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, তাহলে শিকদারকে কেন গ্রেপ্তার করা যাবে না? পুলিশের ভাষায় তাকে কেন ‘গরম ডিম’ দেওয়া যাবে না? জিজ্ঞাসাবাদের স্টাইল তো সব সন্দেহভাজনের জন্য সমান হওয়া উচিত, বিচারের পাল্লা তো সব অপরাধীর জন্য একটাই হওয়া উচিত। তাই না?

মাহমুদ মনি
ডর্টমুন্ড, জার্মানি
১১ জানুয়ারি, ২০১৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *