চেতনার বর্গাচাষ কিংবা বন্দক দেওয়া বিবেক!

Vote and Politicsবাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলি গত দু-তিন দশকে খুব সাফল্যের সঙ্গে একটি কাজ করতে পেরেছে! তা হলো : দেশের মানুষগুলিকে একজোট বাঁধার সুযোগ বেশ ভালোভাবেই বন্ধ করেছে। মানুষের এখন আর কোনো নিজস্ব পরিচয় নেই। তাদের একক কোনো পরিচয় নেই। তাদের পরিচয় এখন নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের ওপর। জাতীয় স্বার্থেও তাই এক হওয়া আর হয় না। বায়ান্ন, ঊনসত্তর কিংবা একাত্তরের বুলি আওরালেও এখন আর কেউ ন্যায্য কথা বলার সাহস করে না। কারণ তিনি জানেন তার নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই। তিনি তার বিবেক বন্দক দিয়েছেন দলের কাছে। চেতনা এখন বর্গাচাষের ভাগাভাগির ফসল।

কোনো শিক্ষক এখন আর সবার শিক্ষক না। কোনো সাংবাদিক সবার সাংবাদিক না। কোনো চিকিৎসকও সবার চিকিৎসক না। কোনো আইনজীবীও সবার জন্য না। এইসব পেশাজীবীসহ আর দশটা পেশায় নিযুক্ত অন্য আমরা হয় আওয়ামী লীগের, নয় বিএনপির, নয় জামাতের কিংবা অন্য কোনো দলের।

আমাদের নিজস্ব আর কোনো পরিচয় নেই। বুক ফুলিয়ে কথা বলার সাহস নেই। ন্যায্য কথা তো দূরের কথা! দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা। মন্ত্রী-এমপিদের টাকা গড়াগড়ি খায় চারদিকে। কিন্তু তাদের এক সহকর্মী সাবেক এমপি মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গুনিয়ায় না খেয়ে মরে গেলেও কেউ কথা বলবে না। কারণ ন্যায্য কথা বলতে গেলে তার ভাগে টান পড়বে। সুতরাং চুপ যা! পারলে ওই বৃদ্ধ কীভাবে না খেয়ে তাড়াতাড়ি মরতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দে!

জাতীয় স্বার্থ বলে এখন আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। কারণ জাতীয় খুব কম ইস্যুতেই সাম্প্রতিক সময়ে সব দল-মতের মানুষ ‘এক’ হয়েছে। যে যেই দলই করুক না কেন, কোনোদিন চোখে পড়লো না যে, বিএনপি বলেছে, আওয়ামী লীগ এই কাজটা ভালো করেছে কিংবা আওয়ামী লীগ বললো না যে বিএনপির এই দাবিটা যৌক্তিক!

দেশের সার্বিক চিত্র যখন এই তখন ছাত্ররাও বাদ যাবে কেন! তাদেরও তথৈবচ। কোনো ছাত্রকে যদি জিজ্ঞেস করেন — ‘কী করো বা করেন?’, হয়তো উত্তর মিলবে ‘ছাত্রলীগ করি’, কিংবা ‘ছাত্রদল করি’ অথবা ‘শিবির’ করি। ‘পড়াশোনা করি’ — এমন সহজ জবাবটা দিতে হয়তো অনেক ছাত্রেরই বুক কাঁপবে।

তেমনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে প্রশ্ন করেন, তিনি কী করেন? জবাব দিতে কিছুটা হলেও কার্পণ্য আসবে। কারণ তিনি ঠিকমতো পড়ান না! তার ধান্ধা থাকে কীভাবে ‘ক্ষ্যাপ’ মারা যাবে। হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, না হয় কোনো প্রজেক্ট বাগানো অথবা ক্যাম্পাসে দলবাজি করা তার অন্যতম লক্ষ্য।

একই অবস্থা সাংবাদিকদেরও। অনেকে ব্যস্ত টকশো নিয়ে। কেউ কেউ ব্যস্ত প্রেসক্লাবের প্লেস পাওয়া নিয়ে। কেউ ব্যস্ত আওয়ামী প্রধানের পরামর্শদাতা হওয়ার পদ পেতে। কেউ ব্যস্ত চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হতে। এই যে বাংলাদেশের এতো এতো মিডিয়া — কয়টা ইন্টারপ্রিটেটিভ রিপোর্ট বা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট হয়েছে গত এক বছরে? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, সত্যিকারের রিপোর্ট ১০টাও হয় নি। ‘তিনি বলেন, তিনি আরও বলেন, কিংবা নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্যসচিব বলেন, অথবা সূত্র জানিয়েছে’-টাইপের সাংবাদিকতাই বেশি। এবং অনেক সংবাদের পেছনেই থাকে ‘উদ্দেশ্য’। ‘নিরীহ সংবাদ’ এবং ‘উদ্দেশ্যমূলকহীন সাংবাদিকতা’র সংখ্যা খুব কম।

প্রায় প্রতিটি পেশায় যখন এমন দলকেন্দ্রিক অবস্থা, তখন জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার সুযোগ পান আমাদের আপারা কিংবা জেনারেলরা। আর জনগণ একেকটা হয় বলীর পাঁঠা। ছাত্র-জনতা-পেশাজীবীদের বিভক্ত করে প্রতিদিন পুজো হিসেবে পাঁঠা বলী দেয় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা।

মাহমুদ মনি
ডর্টমুন্ড, জার্মানি
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *