আমরা এতো ‘উত্তেজিত’ কেন?

ভাবছিলাম বিষয়টা নিয়ে লিখবো না। কিন্তু না লিখেও থাকতে পারছি না। আর লেখা ‍শুরুর আগেই একটা সিদ্ধান্তও দিয়ে দিচ্ছি। আর তা হলো, ‘ বাঙালি (বাংলাদেশ) পৃথিবীর সবচেয়ে ‍উত্তেজিত জাতি’। যে-কোনো কিছুতেই তাদের উত্তেজনার যেন শেষ নেই। এবং বড় আশ্চর্যের বিষয়, মিডিয়ার লোকজন যেন আরও বেশি উত্তেজিত। তারা নিজেরা উত্তেজিত হয় এবং সেই উত্তেজনা নানান কৌশলে পাঠক-দর্শকের কাছে পৌঁছে দিয়ে ব্যবসা আদায় করে নেয়। যেমনটা হচ্ছে ফুটবল নিয়ে। সাংবাদিকদের ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে এখন ফুটবল নিয়ে তর্কবিতর্ক।

এমন ধরনের উত্তেজনা সেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখলাম, শিবিরের পোলাপান মিছিল করে এসে পরে আবার সাংবাদিকতাও করতো। মানে অ্যাক্টিভিজম আর জার্নালিজম মিলে-মিশে একাকার হয়ে যেতো তাদের কাছে। একইরকম দেখলাম গণজাগরণ মঞ্চের ক্ষেত্রেও। আমার দুএকজন সহকর্মী-সাংবাদিককে দেখলাম, বেদম মিছিল করেছে। এরপরে অফিসে এসে আবার নিউজও করেছে। যা-ই হোক, এটা যার যার বিষয়। অ্যাক্টিভিজম আর জার্নালিজম তাদের কাছে ‘সেইম টু সেইম’।

বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে যে উত্তেজনা বাংলাদেশে দেখছি, তেমনটা কোনো দেশে চোখে পড়ে না। কয়েকবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল জার্মানি গেলো আসরে যখন শিরোপা জেতে তখনও আমি জার্মানিতে। খেলার সময় এবারও আছি। গত কয়েকবারের বিশ্বকাপ চলাকালীন কয়েকটি দেশ ভ্রমণও করেছি। কিন্তু কোথাও বাংলাদেশের মতো উত্তেজনা দেখি নি। জার্মানরা অবশ্যই ফুটবল খেলা অনেক পছন্দ করে কিন্তু এখানে কোনো ‘উত্তেজনা’ দেখি নি, এবারও দেখছি না। উত্তেজনার এমন চিত্র চোখে পড়েছিল ‘৯৭ সালে যখন টাইটানিক ছবি মুক্তি পায়। ওই ছায়াছবিটি সারা পৃথিবীতেই ‘সাড়া’ ফেলেছিল। কিন্তু বাংলাদেশিদের কাছে এটা হয়েছিল উত্তেজনার বিষয়। টেলিটকের সিমকার্ড পেতে উত্তেজনায় মানুষ মাথা ফাটিয়েছিল একে অপরের। ডিম দিবসের ডিম নিয়ে ফার্মগেটে সেকি উত্তেজনা! কয়দিন আগে স্যাটেলাইট নিয়ে যেন সবাই একেকজন বিশেষজ্ঞ হয়ে গিয়েছিল। এখন যেমনটা হচ্ছে ফুটবল নিয়ে। বাংলাদেশের সবাই এখন একেকজন ফুটবল বিশেষজ্ঞ! উত্তেজনায় তারা কোপাকুপি পর্যন্ত করছে। ভক্তদেশের পতাকা বানাতে ভিটাবাড়িও বিক্রি করছে উন্মাদ বাঙালি!

ছবি : ইন্টারনেট

ফুটবল নিয়ে মিডিয়াগুলি উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে কৌশলে। সাংবাদিকদের উত্তেজনার সর্বশেষ একটা উদাহরণ দিই। জার্মান এক তরুণী গতকাল ঢাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে তার ক্যামেরা-ল্যাপটপ ইত্যাদি খুইয়েছেন। প্রথম আলো‘র মতো পত্রিকা সেই সংবাদের শিরোনাম দিল ‘কাঁদতে কাঁদতে ঢাকা ছাড়লেন জার্মান তরুণী’। ‘কাঁদতে কাঁদতে’… এমন বিশেষণ দেওয়া শিরোনাম আমার খুব কমই চোখে পড়েছে। মূল্যবান জিনিস হারালে কেউ হাসবে না, এটাই স্বাভাবিক। যেই দেশে ছিনতাই, চুরি খুবই সাধারণ ঘটনা সেই দেশে এমনটা তো হতেই পারে। এতে প্রথম আলো এতোটা কেন উত্তেজিত হলো এবং সেই সংবাদ তিন ঘণ্টার মতো লিডনিউজে ছিল আমার তা বুঝে আসে না।

যেখানে দিনেদুপুরে মানুষ খুনও প্রায় স্বাভাবিক ঘটনায় দাঁড়িয়েছে সেখানে একজন জার্মান তরুণীর ল্যাপটপ-ক্যামেরা তো ছিনতাই হতেই পারে। জার্মান ওই তরুণী কি কোনো বিশেষ প্রটোকলে ছিলেন যে এটা একটা (আমি কোনোভাবেই ছিনতাইয়ের পক্ষে না) অস্বাভাবিক ঘটনা? ঢাকা-চট্টগ্রামে ভোর পাঁচটায় কেউ যদি রিকশায় চড়ে তাহলে তো সে এমনিতেই ছিনতাইয়ের ঝুঁকিতে থাকে। আর বিদেশি নাগরিক এবং দামি জিনিসপত্র সঙ্গে থাকলে তো কোনো কথাই নেই।

তো সেই ছিনতাইয়ের সংবাদ প্রথম আলো যেভাবে লিড করে ঝুলিয়ে রাখলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা… মনে হচ্ছে এই ছিনতাইয়ে সারাদেশ থমকে গেছে। জাতীয় আর কোনো ইস্যু নেই। ওই ছিনতাইয়ের ঘটনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ খবর। কিন্তু কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আজ আবার দেখলাম নামকরা একজন সাংবাদিক ওই ঘটনায় লজ্জা প্রকাশ করে বিশাল এক কলামও লিখে ফেললেন প্রথম আলো‘তে। উত্তেজনা একেই বলে!

বাংলাদেশি কোনো তরুণী যদি অন্য কোনো দেশে গিয়ে তার ল্যাপটপ, ক্যামেরা ইত্যাদি ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে খোয়ান তাহলে সেই দেশের একনম্বর পত্রিকা কি লিডনিউজ করবে??? কোনোদিনও না। তাহলে আমাদের সাংবাদিকরা এতো উত্তেজিত কেন? জার্মানরা কি এলিয়েন? বাংলাদেশে একজন পৌর কমিশনারকে হত্যার অডিও প্রকাশের পর দুইলাইন সংবাদও একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে পারে না, তখন তাদের উত্তেজনা মিইয়ে যায় আর ছিনতাইয়ের বিষয় নিয়ে মানুষকে সেনসিটাইজ করার চেষ্টা করে মিডিয়া! এই হলো অবস্থা।

ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। বছর তিনেক আগে বাংলাদেশি এক সাংবাদিক জার্মানিতে আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি আরেকজন জার্মান সাংবাদিককে দেখতে যাচ্ছিলেন তার বাসায়। যাবার পথে রেলস্টেশন থেকে তার ব্যাগটি চুরি হয়ে যায়। ওই ব্যাগেও ল্যাপটপ, পাসপোর্ট, ইউরোসহ দামি জিনিসপত্র ছিল। কিন্তু এ ঘটনায় জার্মান ওই সাংবাদিক উত্তেজিত হয়ে খবরের কোনো শিরোনাম করেন নি। কোথাও একটা অক্ষরও ছাপা হয় নি! কারণ তারা আমাদের মতো উত্তেজিত না। এই বিষয়টার সঙ্গে জার্মান তরুণীর ঘটনাটা মেলালেই বুঝবেন যে জাতি হিসেবে আমরা কতটা উত্তেজিত!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *