আমেরিকা থেকে মেসেঞ্জারে কল…
মনি, এই শাহেদকে চিনছেন?
না’তো ভাইয়া! কেন?
আরে কি বলেন! মনে নেই আপনার ঘটনা? ওই যে একবার বিজ্ঞাপনের বিলের তাগাদা দিতে গেছিলেন…
ওহ্! হ্যাঁ, ভাইয়া মনে পড়েছে…
আরে এটা সেই শাহেদ, যে আপনাকে হুমকি দিছিলো!
আমার সাবেক বস, অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন, দৈনিক আজাদী ঢাকার ব্যুরোপ্রধান মুক্তিযোদ্ধা এম. ওয়াহিদউল্লাহ’র সঙ্গে কথোপকথন।
ওয়াহিদউল্লাহ ভাই কিছুক্ষণ আগে আমেরিকা থেকে ফোন দিলেন। মেয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে করোনার কারণে সপরিবারে সেখানে আটকা পড়েছেন। মাঝে মাঝে কথা হয়। কিন্তু আজকের ফোনটা অনেকটাই যেন অপ্রত্যাশিত।
ফিরে আসি শাহেদ প্রসঙ্গে…
বছর দশেক আগের ঘটনা। ঢাকায় দৈনিক আজাদীতে তখন আমি কর্মরত। বিজ্ঞাপনের লাখো-কোটি টাকা বছরের পর বছর আটকে আছে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে। অনেক তাগাদায়ও যেন কাজ হয় না। কিছু বিজ্ঞাপনদাতা আছে খুবই ত্যাঁদড় টাইপের। বিপণন কর্মকর্তা গোফরান ভাইয়ের পেরে ওঠার তাই কোনো কারণ নেই। ওয়াহিদউল্লাহ ভাইও নিখাঁদ ভদ্রলোক। পাওনা টাকা আদায় সত্যিই একটা বিশ্রী কাজ। ভালো করে বললে দেয় না। খারাপ করে বললে সম্পর্ক নষ্ট হয়। দুদিকেই সমস্যা।
আজাদীর সম্মানিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদ মালেক মাঝে মাঝে কথাপ্রসঙ্গে এ নিয়ে টুকটাক বলতেন। সম্পাদক মালেক স্যার প্রায়ই ঢাকায় আসতেন। পত্রিকা চালানোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়টা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতোগুলো লোকের বেতন দিতে হয় মাসের নির্দিষ্ট সময়ে। (আমার বিশ্বাস, আজাদীই এখন পর্যন্ত মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে বেতন দেওয়া অন্যতম পত্রিকা)। সুতরাং বিজ্ঞাপনের বিলগুলো যথাসময়ে প্রাপ্তির তাগিদ অনুভব করতেন সম্পাদক স্যারও।
বিজ্ঞাপনের সঙ্গে আমার কাজের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। সম্ভবপর সহযোগিতা আমি করতাম, করতে হতো। ভালোই লাগতো। এতো এতো টাকার খবর পেলে খারাপ লাগতো না। কারণ এ আয় থেকেই হয়তো আমার মাসের বেতন মিলবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে কার খারাপ লাগে! অবস্থা এমন হয়েছে যে, কখনও বড় বড় ফাইলের বিজ্ঞাপন এলে সেগুলো প্রসেস করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে হেডঅফিসে পাঠানোকেই আমি গুরুত্ব দিয়েছি। চট্টগ্রামে ফোন করে বলেছি, ‘আজ তেমনকিছু’ (সংবাদ) নাই, যা আছে এজেন্সি থেকে দিয়ে দেন। আমি পুরো একপাতা বিজ্ঞাপনের একটা ফাইল পাঠাচ্ছি, সময় লাগছে…
যা-ই হোক, বিজ্ঞাপনের টুকটাক সহযোগিতার কাজ অফিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও একবার ওয়াহিদউল্লাহ ভাই বললেন, মনি, একটা বিল নিয়ে খুবই বেকায়দায় আছি, প্রায় দেড়লাখ টাকার একটা বিল নিয়ে একলোক বেশ ঘুরাচ্ছে। আপনি যদি গোফরান সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে একবার যেতেন। ধানমণ্ডিতে ওই লোকের অফিস। বিডিএস ক্যুরিয়ার সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালান ওই লোক।
কোনো এক গ্রীষ্মের দুপুর। ঘর্মাক্ত অবস্থা। বিকেল তিনটা কি চারটা হবে। আমি আর গোফরান ভাই গেলাম ওই লোকের অফিসে। নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করার পর অনুমতি মিললো তাঁর রুমে ঢোকার। রিভলবিং বিশাল এক চেয়ার ঘুরিয়ে সেই এক ভাব নিয়ে লোকটা বললেন, কী চাই!? গোফরান ভাই আমতা আমতা করতে লাগলেন। কথা কেড়ে নিয়ে আমি বললাম, বিজ্ঞাপনের কিছু বিল বাকি ছিল। (ভেতরে ভেতরে আমার ভাবখানা এমন, আমি কাগজের রিপোর্টার। বিল না দিলে খবর আছে আরকি!) লোকটা রাগি রাগি ভাব নিয়ে বলে উঠলেন, কীসের বিজ্ঞাপন? কীসের বিল? আমি একটু রেফারেন্স দিতেই অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলে উঠলেন, আপনার সাহস তো কম না! আমার কাছে বিল চান? জানেন আমি কে? আমি আর্মির মেজর! আমার কাছে টাকা চাইতে আসছেন? চাঁদাবাজি করতে চান? সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজি শুরু হইছে? কত সাংবাদিক আমি পালি জানেন? এখনই পুলিশে কল করে চাঁদাবাজ হিসেবে ধরিয়ে দেবো! দাঁড়ান ফোন দিই।
আমি সত্যিই যেন ভয় পেয়ে গেলাম। এমন ঘটনা কিন্তু মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় পড়ি, নিজেরাই হয়তো লিখিও— ‘চাঁদাবাজির দায়ে সাংবাদিক আটক!’ চোখ-কান দিয়ে যেন গরম বাতাস বের হচ্ছে! ফুলটাইম-পার্টটাইম মিলিয়ে ১৫ বছরেরও বেশি সময় সাংবাদিকতা করেছি। বহু ভালো মানুষের দেখা পেয়েছি, দেখেছি চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীও। কিন্তু কোনোদিন ভয় ঠিক পাই নি! জীবনে কেউ কোনোদিন এমন কথা বলারও সাহস পায় নি। আজ এ কোন্ ‘মাইন্কাচিপায়’ পড়লাম!? আমি একটু তর্ক করার চেষ্টা করলাম। তাকিয়ে দেখি, গোফরান ভাই যেন রীতিমতো কাঁপছেন আর আমাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করছেন। আস্তে আস্তে আমার গায়ে স্পর্শ করে বলছেন, ‘থাক্ মনি ভাই, চলেন, চলি যাই…’ আর পুঁচকে আমিও মানসম্মানের এক ধরনের ভয়ে চলে আসারই সিদ্ধান্ত নিই।
ওই লোকের অফিস থেকে বের হতে হতে গোফরান ভাই বললেন, ‘মনি ভাই আম্নের সাবাস (সাহস) আছে। কিন্তুক হেতে লোক ভালা না। কতা আর বেশি বইল্লে জামেলা অইতো। আমি এইজইন্য আম্নেরে চলি আইসতে বইল্লাম।’
অফিসে এসে ওয়াহিদউল্লাহ ভাইকে ঘটনা সবিস্তারে বললাম। তিনি বললেন, যাক ভালো হইছে চলে আসছেন। ঝামেলা বাড়ান নাই ভালো হইছে।
এমন অভিজ্ঞতা জীবনে একবারই। এভাবে একবারই গেলাম টাকা প্রাপ্তির তাগাদা দিতে, আর ফেল মারলাম। এরপর তিনি আমাকে আর কোনোদিন এমন কাজে পাঠান নি। আমিও ভুলে গেছি সেই ঘটনা।
ওয়াহিদউল্লাহ ভাই আজ হঠাৎ আমেরিকা থেকে ফোন দিয়ে বললেন… ‘মনি, এই শাহেদকে চিনছেন? এটা সেই শাহেদ, যে আপনার সঙ্গে বিজ্ঞাপনের টাকা নিয়ে ঝামেলা করছিলো!’ হয়তো তিনি আমার ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে ফোন দিয়েছেন।
এই সেই শাহেদ, যাঁকে আমি প্রায় ১০ বছর আগে থেকে চিনি। তিনিই রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান শাহেদ, যাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।
ওয়াহিদউল্লাহ ভাইয়ের ফোন রাখতে রাখতেই কম্পিউটারের মেমোরির মতো ট্যা ট্যা করে মনে পড়ে গেলো সেদিনকার ঘটনা। তাঁর চেহারাটাও যেন ভেসে ওঠলো মস্তিষ্কের দেয়ালে। ততক্ষণে ডিনারের জন্য বৌ’র তাগাদা… কেটে গেলো স্মৃতি… আর অস্ফুট স্বরে নিজের অজান্তেই হুজুরীয় স্টাইলে যেন বলে ওঠলাম, ‘ওরে বাটপার! ওরে চিটার!!’