আমি জানি না, আজাদ ভাই কথা বলার মতো অবস্থায় আছেন কি-না। যদি একটু কথা বলতে পারতাম তাহলে বোধহয় অনেক বেশি হালকা লাগতো নিজেকে।
সেদিন অফিসের মিটিংশেষে হঠাৎ ফেসবুকে ঢুকেই অসুস্থ আজাদ ভাইয়ের (একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার) একটা ছবি দেখে মনটা দুমড়েমুচড়ে গেলো। পুরো অফিসে একটা লোকও নেই যে কারও সাথে মনের কথাটা বাংলায় বলে একটু হালকা হবো।
এরপরই আমার শুরু পালপিটেশন্স। একটু অস্থির হলেই ইদানীং এমনটা হয় আমার। জোরে শব্দ শুনতে পারি না, দুশ্চিন্তা করতে পারি না। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়।
কয়েকঘণ্টা চলে গেলো এভাবেই। ফুড ডেলিভারির লোক এসে কখন বেল চাপলো খেয়ালই করি নি। কেমন যে লেগেছে তা ওপরওয়ালাই শুধু জানেন। বিকেলে বাসায় ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে কিছুটা হালকা লাগলো।
আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে কি যেন এক অজানা অভিমানে বেশ কয়েকবছর ধরেই আমার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো। অথচ চট্টগ্রামে থাকতে এমন কোনোদিন হয়তো খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যেদিন আমাদের দেখা হতো না, কথা হতো না।
দৈনিক আজাদীর পাশের ভবনেই তাঁর অফিস আর পাশের গলিতে বাসা থাকার কারণে দেখা হতে না চাইলেও দেখা হতোই।
তিনি খেতে ভালোবাসতেন, খাওয়াতে ভালোবাসতেন। তাই তাঁর বাসায় পার্টি লেগেই থাকতো। আমিও নিয়মিত দাওয়াত পেতাম। মাঝে মাঝে আবদার করতেন, মনি, আজকে ইলিশ খাবো। চুমকীকে বলেন, ইলিশ রান্না করতে। বাসায় ইলিশ না থাকলে মনে মনে বিব্রত হতাম। একদিন উনি বললেন, আমি ইলিশ নিয়ে আসবো। সম্ভবত ইলিশ নিয়েও এসেছিলেন একবার-দুবার।
বয়সে সিনিয়র হলেও চট্টগ্রামের আরও অনেক সাংবাদিকের মতো আমাকে দেখতেন বন্ধুর মতোই, অনেক আপন ভাবতেন। তাঁর ব্যক্তিগত কষ্টের কথাও বলতেন। আমি ছোটো হলেও তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম।
মজার বিষয় হচ্ছে, তাঁর বিয়ে খেয়েছি আমি এবং আমার বিয়ে করিয়েছেন তিনি। আমাদের বিয়ের শাড়িটাও তিনি আমার স্ত্রীকে রেয়াজুদ্দিনবাজার নিয়ে গিয়ে কিনে দিয়েছেন। অফিসের পিকআওয়ার হওয়ায় আমি যেতে পারি নি।
এনটিভি’র আরিচ ভাই আর আজাদ ভাই এতো ব্যস্ততার মধ্যেও চট্টগ্রাম থেকে আগেই ফেনী চলে গিয়েছিলেন দৈনিক পূর্বকোণের সাবেক সাংবাদিক (বর্তমানে ব্যাংকার) শওকত ভাইয়ের বাসায়।
আরিচ ভাই আর আজাদ ভাই না থাকলে বিয়ের আয়োজন এতো সুন্দরভাবে সম্পন্ন হতো না।
টাকাপয়সার টানাপোড়েন থাকায় প্রায় সব সহকর্মীই আমাকে নগদ অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করলেন। আজাদ ভাই দিয়েছিলেন ৪,০০০ টাকা। আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে এটা নেহাত কম টাকা ছিলো না। তখনও ‘আলী হোটেল’-এ ১০ টাকায় ভরপেট ভাত খাওয়া যেতো।
সবার টাকা ফেরত দিতে পারলেও আজাদ ভাইয়ের টাকা আমি ফেরত দিতে পারি নি। ফেরত দিতে চাইলেই তিনি বলেছেন, মনি, আপনার কি মাথা নষ্ট হয়েছে!? এটা আমি আপনাকে গিফ্ট হিসেবে দিয়েছি। পরে আরও জোরাজুরি করলে তিনি বললেন, এটা নিয়ে আর কথা বললে আপনার সাথে আমার কথা বলাই বন্ধ হয়ে যাবে…
আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেশে-বিদেশে বহু ট্যুর হয়েছে। সেই সাউথ আফ্রিকার ডারবান থেকে কাতারের দোহা, পোল্যান্ডের ওয়ারশো, ফ্রান্সের প্যারিস, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাসহ পুরো ইউরোপ আমরা একসঙ্গে চষে বেড়িয়েছি…
সাবেক পরিবেশমন্ত্রী আর বর্তমান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হওয়ার অন্যতম নিয়ামক আজাদ ভাই। ড. হাছান মাহমুদ আজাদ ভাইয়ের নিজের এলাকার বড়ভাই আর আমার ভার্সিটির বড়ভাই। আমি দৈনিক আজাদীর হয়ে ঢাকায় আসার পর সচিবালয়ের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে হাছান ভাইয়ের রুমে প্রায়ই আড্ডা হতো। আরেক প্রিয় বড়ভাই সরকারের তথ্যকর্মকর্তা কবি মোস্তফা কামাল পাশা ভাইও থাকতেন সেখানে। আজাদ ভাই মন্ত্রীর কাছে বাড়িয়ে বাড়িয়ে আমার অকারণ প্রশংসা করতেন। যেটা তিনি সবসময় সবার ক্ষেত্রেই করতেন।
এতো হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক কীভাবে কীভাবে যেন মলিন হয়ে গেলো। বেশি হয়েছে যখন উনি দ্বিতীয় সম্পর্কে জড়ালেন। যদিও এটা আমার কোনোভাবেই উচিত হয় নি। আমি জানতাম তিনি পারিবারিকভাবে অসুখী। আমি বলেছিলাম, এই অসুখিতা নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে। একমাত্র ছেলে তালাল তখনও অনেক ছোট। তাই তিনি যখন দ্বিতীয় বিয়ে করলেন, আমার বেশ অভিমান হলো। এর আগে যে কথা কমতে শুরু করেছিল তাতে একেবারে যবনিকাপতন হলো। ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করে দিলাম। এটা আমার কোনভাবেই উচিত হয় নি। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা প্রত্যেকটা মানুষের আছে।
তবে ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করলেও মন থেকে করতে পারি নি।
মাঝে মাঝেই তাঁর ওয়াল ঘুরে আসতাম। আপডেট পাওয়ার চেষ্টা করতাম। তাঁর পত্রিকা পড়তাম অনলাইনে। পত্রিকার ইউটিউব চ্যানেলে ঢুঁ মারতাম। বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রের তাঁর অনুষ্ঠান-উপস্থাপনা দেখতাম।
আজাদ ভাই অসুস্থ, তা শোনার পর থেকে লুকিয়ে খোঁজ নেওয়ার পরিমাণটা আরও বেড়ে গেলো। ভারতের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসার আপডেট পেতাম তাঁর ফেসবুক থেকেই। তাঁর মনোবল দেখে স্বস্তি পেতাম।
কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক ছবিটা দেখে মনটা ভেঙে গেলো। সুঠামদেহী মানুষটা এখন জীর্ণশীর্ণ। ক্যান্সারের বিষাক্ত ছোবলে তিনি বীষে নীল। কিন্তু তাঁর মনোবল এতোটুকু টলে নি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, ক্যান্সার তিনি জয় করবেনই।
ফেসবুকজুড়ে তাঁর জন্য প্রার্থনা। ক্যান্সারকে জয় করে তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসুক।
আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, তিনি রাত-দিন কীভাবে পরিশ্রম করতে পারেন। একুশে পত্রিকাকে তিনি একা এতোদূর নিয়ে এসেছেন। একবার উনি পত্রিকার জন্য লেখা চাইলেন, আমি গড়িমসি করি দেখে উনি অগ্রিম টাকা দিলেন। আমি লজ্জায় আর না করতে পারি নি। ঢাকায় চলে আসার পরও তিনি নিয়মিত লেখা চেয়েছেন। আজাদ ভাই প্রায়ই বলতেন, মনি আমাদের শক্তি হচ্ছে চারটা হাত-পা। মেধাটেধা কিছুই না। এটা ছিলো আমারও কথা। দুজনের ফিলোসফি মিলে যেতো। বাংলা বানান নিয়ে তিনি ছিলেন যথেষ্ট খুঁতখুঁতে। একেবারে ঠিক আমার মতো। এই জিনিসটা আমার খুবই ভালো লাগতো। মিল খুঁজে পেয়ে আমি খুশি হলে তিনি বলতেন, আপনি তো ভাই ড. মাহবুবুল হকের ছাত্র। আমি তো কিছুই না।
লেখা চাইলে আমি ব্যস্ততার অজুহাত দিলে তিনি বলতেন, আপনার লেখা কেন চাই জানেন? জিজ্ঞেস করলাম, কেন? আপনি ভালো লিখেন, আপনার লেখা এডিট করতে সময় লাগে না।
ধুর। আপনি মানুষের আজাইরা প্রশংসা করেন।
দোষগুণ মিলিয়েই মানুষ। আজাদ ভাইও তা-ই। এসব বাদ দিলে তাঁর যে কর্মস্প্রীহা, মানুষকে সহজে আপন করে নেওয়ার যে ক্ষমতা তার প্রশংসা না করলে খোদাও হয়তো রাগ করবেন।
একটা কথা আছে, বাবা-মা আমাদের প্রাকৃতিক। এটা আমরা অর্জন করি না। কিন্তু বন্ধু আর স্বজন আমরা অর্জন করি নিজের ঔদার্য দিয়ে। আজাদ ভাই সেটা করতে পেরেছেন শতভাগ। বন্ধু আর স্বজনদের দোয়ায় আল্লাহ নিশ্চয়ই তাঁকে সারিয়ে তুলবেন। আল্লাহ্র কাছে এই মিনতি করি।
জানি না এই লেখাটা পড়ার মতো অবস্থায় আজাদ ভাই আছেন কি-না। যদি লেখাটা তাঁর চোখে পড়ে তাহলে বলবো, প্রিয় আজাদ ভাই, আমার দোষত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ছোটভাই-বন্ধু হিসেবে মাফ করে দেবেন।
সুযোগ পেলে আপনার সঙ্গে একটা মিনিটের জন্যে হলেও একটু কথা বলতে চাই…